আচরণবাদের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, সমালোচনা এবং গুরুত্ব আলোচনা

 

definition-characteristics-and-importance-of-behaviourlism

আচরণবাদের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, সমালোচনা এবং গুরুত্ব আলোচনা || Definition, Characteristics And Importance Of Behaviourlism


আচরণবাদের উৎপত্তি ; প্রাচীনকালে প্লেটো, অ্যারিস্টটলের সময়কাল থেকে শুরু করে উনিশ শতকের শেষ কাল পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত ছিল,তা হল প্রচলিত বা সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি। বিশ শতকে আমেরিকায় এক শ্রেণীর চিন্তাবিদদের উদ্ভব ঘটে যারা প্রচলিত সাবেকি বা অনুমান নির্ভর পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনা না করে, সম্পূর্ণ বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের কথা বলেন। মূলত সাবেকি অনুমান নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গি গুলির বিরুদ্ধে বা প্রতিবাদ স্বরূপ এই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়েছিল। আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়েছিল মূলত বিশ শতকের শুরুতে। তবে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্ব লাভ করতে শুরু করেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে।

▪ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্ত ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে অনুমান নির্ভর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম হয়েছিল। এই আচরণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি হলো এক অভিজ্ঞতাবাদী, আধুনিক এবং বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি।
আচরণবাদের আলোচনা শুরু করেছিলেন গ্রাহাম ওয়ালাস ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর 'Human Nature In Politics' গ্রন্থে। এবং আর্থার বেন্টলে, একই বছরে প্রকাশিত তার 'The Process Of Government' নামক গ্রন্থে।
▪ তবে আচরণবাদের জনক বলা হয় চালর্স মেরিয়ামকে। কারণ তার হাত ধরেই আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৃতপক্ষে আচরণবাদী আলোচনা শুরু হয়।


আচরণবাদের অর্থ ও সংজ্ঞা ; (Meaning And Definition Of Behaviourlism)

আচরণবাদের কোনো নির্দিষ্ট সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা নেই। তাই আচরণবাদ বলতে কী বোঝায় তা বলা খুবই কঠিন। তবে বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের সংজ্ঞা থেকে আচরণ বাদ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। বিভিন্ন খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগন আচরণবাদের ভিন্ন ভিন্ন অর্থ এবং সংজ্ঞা দিয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সংজ্ঞা হলো-

আর্নল্ড ব্রেখটস তাঁর পলিটিকাল থিওরি গ্রন্থে আচরণবাদ সম্পর্কে বলেছেন, আচরণবাদ হল রাজনৈতিক জীবন ও আচরণ সম্পর্কে একটা অভিজ্ঞতাবাদী ও এক স্থায়ী তত্ত্ব গঠনের প্রচেষ্টা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রবার্ট ডালের মতে, আচরণবাদ হল এক প্রতিবাদী আন্দোলন ও পদ্ধতি যা ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণশীল রাজনৈতিক আচরণের ভিত্তিতে রাজনীতির ব্যাখ্যায় সচেষ্ট।
গিল্ড এবং পামারের মতে, আচরণ বাদ হলো যেকোনো ঘটনার সুসংঘবদ্ধ, অভিজ্ঞতাবাদী হেতু সংক্রান্ত ব্যাখ্যা।
আবার, ডেভিড ট্রুম্যান আচরণবাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, আচরণবাদের উদ্দেশ্য হলো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়, বিজ্ঞান গঠন করা।

উপরিক্ত কয়েকটি সংজ্ঞা ভিত্তিতে যদি আমরা সংক্ষেপে আচরণবাদ সম্পর্কে বলতে পারি যে- আচরণবাদ হলো সেই আধুনিক,বৈজ্ঞানিক, মূল্যনিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় ঐতিহাসিক, দার্শনিক ও প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার পদ্ধতির পরিবর্তে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণশীল রাজনৈতিক আচরণের উপর গুরুত্ব দিয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রাজনীতির ব্যাখ্যা করে।।

আচরণবাদের একটা উদাহরণ ; আচরণবাদ কিভাবে বা কী নিয়ে আলোচনা করে তার একটা উদাহরণ দেখলে আচরণ বাদ সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হবে।
যেমন- ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে গান্ধীজি ভারতছাড়ো আন্দোলন শুরু করলেন। কিন্তু তিনি কেন করলেন? কোন পরিস্থিতিতে করলেন? কী উদ্দেশ্য নিয়ে তা করলেন? আন্দোলন ব্যর্থ হলো কেন? এই বিষয়গুলো আচরণবাদীরা অনুমান বা কল্পনার ভিত্তিতে নয় বরং তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য যাচাই করনের মাধ্যমে করবেন।

আচরণবাদের কয়েকজন সমর্থক ; আচরণবাদের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য সমর্থক হলেন ডেভিড ইস্টন, রবার্ট ডাল,হ্যারল্ড ল্যাস ওয়েল, জর্জ ক্যাটলিন, চালর্স মেরিয়াম প্রমুখ।


আচরণ বাদের বৈশিষ্ট্য ( Characteristics of behaviourlism) ;

প্রথমত ; ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণের উপর গুরুত্ব ;

▪ আচরণবাদ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আলোচনার পরিবর্তে ব্যক্তি এবং ব্যক্তি গোষ্ঠীর পর্যবেক্ষণশীল রাজনৈতিক আচরণের আলোচনার উপরেই অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কারণ তাদের মতে ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণের আলোচনা করাই হলো রাজনৈতিক আলোচনা।

দ্বিতীয়ত, মূল্য নিরপেক্ষ আলোচনা ;

▪ আচরণবাদ হলো সম্পূর্ণভাবে মূল্যনিরপেক্ষ। আচরণবাদীতা তাদের আলোচনায় ভালো-মন্দ,উচিত অনুচিত,এই বিষয়গুলো রাখেন না। কারণ তারা মনে করেন- সমস্ত বিজ্ঞানের আলোচনা মূল্য নিরপেক্ষ হয়ে থাকে। তাই রাষ্ট্রবিজ্ঞান যদি একটি বিজ্ঞান হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাও মূল্য নিরপেক্ষ হতে হবে।

তৃতীয়ত ; বিজ্ঞান সম্মত আলোচনা ;

▪ আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনাকে সম্পূর্ণ বিজ্ঞান ভিত্তিক করতে চান। সেই কারণে তারা তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কল্পনা বা অনুমানের বদলে বাস্তব রাজনৈতিক ঘটনার পর্যবেক্ষণ, সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ, তথ্য যাচাই করন- প্রভৃতির করার মাধ্যমে তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন। এবং এভাবেই সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মতভাবে তারা রাজনীতির ব্যাখ্যা করে থাকেন। 

চতুর্থত ; তত্ত্ব ও গবেষণার মধ্যে সংহতি ;

▪ আচরণবাদে তত্ত্ব ও গবেষণার পারস্পরিক নির্ভরশীলতার উপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়। আচরণবাদে অভিজ্ঞতাবাদী তত্ত্ব এবং গবেষণার মধ্যে সংহতি সাধনের চেষ্টা করা হয়। আচরণবাদীরা মনে করেন, শুধুমাত্র তত্ত্ব রচনা করা নয়, সেই তত্ত্বকে বাস্তব গবেষণার মাধ্যমে যাচাই করতে হবে। এবং যাচাইয়ের ফলে যে তথ্য আসবে, সেই তথ্যই রাজনৈতিক তত্ত্বকে সমৃদ্ধ করবে।

সমাজ বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন ;

▪ আচরণবাদ ব্যক্তির রাজনীতিক আচরণের উপরেই সবচাইতে বেশি গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। কিন্তু ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণ তার সব আচরণের একটি অংশ মাত্র। ব্যক্তির রাজনৈতিক আচরণ সঠিকভাবে বুঝতে গেলে অবশ্যই তার সামগ্রিক জীবনধারার আচরণ বা তার সামাজিক আচরণ সম্পর্কে বুঝতে হবে। কিন্তু সেটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অন্যান্য সমাজবিজ্ঞানের শাখা, বিশেষ করে মনস্তত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং মনোবিজ্ঞানের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেন।

প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার বিরোধী ;

▪ সাধারণভাবে আচরণবাদী রাষ্ট্রবিজ্ঞানিগণ প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক আলোচনার বিরোধী। তাঁরা চাপসৃষ্টিকারী গোষ্ঠী, রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক সামাজিক- করণের বিভিন্ন মাধ্যম প্রভৃতিকে সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান (formal institutions ) বলে মনে করেন না। আচরণবাদীরা ক্ষমতা প্রয়োগ (use of power)-এর সঙ্গে সংযুক্ত যে-কোন কার্য'কেই রাজনৈতিক কার্য বলে বর্ণনা করে তাকে রাষ্ট্র- বিজ্ঞানের আলোচনার অন্তর্ভূক্ত করার পক্ষপাতী।


আচরণবাদের সমালোচনা (Criticism of behaviourlism) ;

▪ আচরণবাদের যেমন নানা ভালো দিক রয়েছে, ঠিক সেরকমই বেশ কিছু সমালোচনা করার মতও দিক রয়েছে। যেমন-

প্রথমত ; মূল্যবোধকে পুরোপুরি ভাবে উপেক্ষা করা ;

▪ আচরণবাদ সম্পূর্ণভাবে মূল্য নিরপেক্ষ। এখানে কোনটা ভালো, কোনটা খারাপ তার মাপকাঠিতে আলোচনা হয়না। কিন্তু অনেকের মতে রাজনীতির আলোচনা কখনোই মূল্যবোধকে বাধ দিয়ে বা ভালো-মন্দ, উচিত অনুচিত, কাঙ্খিত- অনাকাঙ্ক্ষিত এই বিষয়গুলোকে বাদ দিয়ে হতে পারে না।

▪ দ্বিতীয়ত ; অযথা জটিলতার সৃষ্টি ; 

▪ সমালোচকদের মতে,আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য, রাজনীতির আলোচনায় যে নতুন পদ্ধতি এবং নতুন শব্দ প্রয়োগ করেছেন, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অযথা জটিলতার সৃষ্টি করেছে।।

▪ তৃতীয়ত ; আচরণবাদের রাষ্ট্রহীন আলোচনা অচল ;

▪ সমালোচকদের মতে, রাষ্ট্র হল রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনার কেন্দ্রীয় বিষয়। তাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন পূর্ণাঙ্গ ও অর্থবহ আলোচনা হতে পারে না। কিন্তু আচরণবাদে রাষ্ট্রকে অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে প্রতিপন্ন করা হয়। সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্টানের আলোচনাও এখানে বাদ দেওয়া হয়। তাই বলা হয়, আচরণবাদের রাষ্ট্রহীন আলোচনা অচল।

▪ চতুর্থ ; রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বতন্ত্রতা বিপন্ন ;

▪ অনেকের মতে, আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে সমাজবিদ্যা, মনোবিদ্যা, নতত্ত্ব,যোগাযোগ ভর, অঙ্কশাস্ত্র, পরিসংখ্যান, তত্ত্ব প্রভৃতির উপর এত বেশী নির্ভরশীল করে তুলেছেন যে, তাদের জন্য রাষ্ট্রবিজ্ঞান স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে নিজের অস্তিত্ব হারাতে বসেছে।

▪ অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ;

▪ রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি সামাজিক বিজ্ঞান। সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমাজের বাস্তবচিত্রকে বিশ্বাস সম্মতভাবে তুলে ধরতে পারছে কিনা, সেখানেই তার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির সার্থকতা লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু আচরণবাদীরা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় অন্যান্য প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতিকে যেভাবে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে চায়, তা অনেকেই স্বীকার করতে চান না। কারণ, প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের আলোচনা পদ্ধতি প্রয়োগ করলেই যে আলোচনা বিজ্ঞানসম্মত হয়ে যাবে এমন কোন কথা নেই।।

আচরণ বাদের গুরুত্ব ; 

নানা দিক থেকে আচরণবাদের সমালোচনা করা হলেও, রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে প্রকৃত বিজ্ঞানের পর্যায়ে উন্নীত করার জন্য আচরণবাদীদের চেষ্টা কখনোই অস্বীকার করা যায় না।

আরও জানো👉 : রাষ্ট্র এবং সমাজের মধ্যে থাকা ৬টি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য

এটা পড়ো👉 : রাজনৈতিক তত্ত্ব বা কাকে বলে? রাজনৈতিক তত্ত্বের সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য এবং গুরুত্ব
আরও জানো👉 ; অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট সম্পর্কে A2Z বিষয়

আরও পড়ে দেখো👉 ; সাম্য এবং স্বাধীনতার মধ্যে সম্পর্কে আলোচনা করো

আরও পড়ে দেখো👉 ; নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি কী? নীতিমানবাচক দৃষ্টিভঙ্গি বৈশিষ্ট্য কী?